
উত্তর: ভূমিকা: 'নদীর বিদ্রোহ' নামাঙ্কিত গল্পে নদের চাঁদের সঙ্গে নদীর সুগভীর সম্পর্ক রচিত হয়েছে। আলোচ্য গল্পে দুটি নদীর কথা আছে। একটি হল নদেরচাঁদের গ্রামের নদী, আর একটি হল তার কর্মস্থানে নদীটি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন ৩০ বছর বয়সেও নদেরচাঁদের নদীর প্রতি গভীর হৃদয়ের সমাজ তার কোথাও ঘাটতি পড়েনি। সে নিজেও জানে নদীর জন্য অদ্ভুত এক পাগলামো রয়েছে তার।
নদীর রূপ: নদেরচাঁদ রেল লাইন ধরে এক মাইল দূরে নদীর ওপরকার সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। টানা পাঁচদিন বৃষ্টির পর আজ নদীকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আর সেই জন্য নদের চাঁদের আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। পাঁচদিনের আকাশভাটা বৃষ্টির পর নদী যেন এক অপরূপ রূপ ধারণ করেছে। দু'দিকে মাঠঘাট জলে ডুবে গিয়েছে। আর নদেরচাঁদ নদীর বর্ষণপুঞ্জ মূর্তি কল্পনা করে আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছে। পাঁচদিন আগেও বর্ষার জলে পরিপুষ্ট নদীর সেই নদী ক্ষেপে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর মুষলধারায় আরম্ভ হলে নদেরচাঁদ বসে বসে ভিজতে থাকে। নদী থেকে একটা ভীষণ মধুর ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। নদীর রূপ দেখে নদের চাঁদ ভয় পেয়ে যায়। তার মনে হয় রাগে ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে এই নদী। তার রাগের কারণ হল তার গতিপথে অসংখ্য বাঁধ ও সেতু বসিয়ে চলার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। ফলে নদীর ভবিষ্যত দেখতে পায় নদেরচাঁদ। তার মনে হয় এই নদী একদিন ক্ষীণস্রোতা নদীতে পরিণত হবে। এভাবে নদী হারিয়ে যাবে।
2. নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে নদীর বিদ্রোহের কারণ কী ছিল? সে কীভাবে তা বুঝিতে পারিয়াছে?
উত্তর: বিদ্রোহের কারণ: 'নদীর বিদ্রোহ' গল্প অনুসারে আজন্ম নদীর ধারে বেড়ে ওঠা নদেরচাঁদ নদীর প্রতিটি আচরণের তাৎপর্য জানত। বর্ষার জলে উপচে পড়া নদীকে সে ক্ষিপ্ত, বিক্ষুদ্ধ বলে জানত। মানুষের তৈরি বাঁধ ও সেতু নদীকে বন্দি করে ফেলেছিল। বর্ষার আগমনে সেই নদী নিজের রূপ পাল্টে ফেলে। নদেরচাঁদ তার সংবেদনশীল অন্তজগৎকে উপলব্ধি করেছিল নদীর বিক্ষোভের ভাষায়। যুগ যুগ ধরে মানুষের প্রযুক্তির কাজে অবদমিত প্রকৃতি নদীর মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে চাইছে। তাই শীর্ণকায়া নদী পরিণত হয়েছে। প্রকৃতির প্রতি মানুষের অবিচার একদিন মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। এই সমস্ত উপলব্ধি করে নদেরচাঁদ বুঝেছিল নদীর বিদ্রোহের কারণ।
নদেরচাঁদের উপলব্ধি: নদেরচাঁদ একজন সংবেদনশীল, শিল্পী মনের মানুষ। নদী সম্পর্কে তার কৌতূহল আকর্ষণ পাগলামির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন নদীর সান্নিধ্য কাটানোর কারণে নদীর প্রতিটি পরিবর্তনের তাৎপর্য তার জানা ছিল। নদী বর্ষার জলে তার রূপ পরিবর্তন করলে সে প্রথম অবাক হলেও পরবর্তীকালে এক সিদ্ধান্তে উপনীত হন। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে উন্নত মানুষ নিজের শক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে প্রকৃতির বুকে সৃষ্টি করেছে তার নিজের কৃতিত্ব। নদীকে বাগে আনতে তার বুকে বাঁধ দিয়েছে, সেতু তৈরি করেছে। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে নদীর গর্জনে। কারণ সে সেতু ও বাঁধ ভেঙে ফেলতে চায়। প্রকৃতির এ আচরণ নদের চাঁদ উপলব্ধি করেছে।
3. নদীর বিদ্রোহ গল্পে নদেরচাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লেখক কোন ছবি অঙ্কন করেছেন?
উত্তর: ভূমিকা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নদীর বিদ্রোহ' গল্পটি লেখকের জীবন দর্শনের ফসল। এখানে জড় পদার্থের ওপর জীবনসত্ত্বা আরোপ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য এক বার্তা দিতে চেয়েছেন। তবে নদীর ভালোলাগা যেন নদেরচাঁদের মধ্য দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে। Doing and suffering হল গল্পটির কেন্দ্রীয় বিষয়।
লেখকের মনোভাব: আলোচ্য গল্পে দুটি প্রতিপক্ষ রয়েছে একদিকে নদেরচাঁদ অন্যদিকে সই। একদিকে যন্ত্রনির্ভর মানবসভ্যতা অন্যদিকে আকৃতি। নদেরচাঁদ নদীকে ভালোবাসতো, নদীর প্রতি তার সহানুভূতি আছে। বর্ষার জলে নদীকে দেখে তার মনে হয়েছিল নদী যেন ক্ষেপে উঠেছে। বন্দিনী নদীর মুক্তি আকাঙ্খা নদেরচাঁদকে আতঙ্কিত করেছে। মানুষের প্রতিনিধি, নদেরচাঁদ নদীর প্রতিহিংসা থেকে বেঁচে পালাতে চেয়েছে। কিন্তু মানুষের তৈরি প্রযুক্তির ফসল ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে নদেরচাঁদ মারা গেছে। এ যেন মানবসভ্যতার প্রতি এক শতর্কীকরণ। অর্থাৎ প্রকৃতি একদিন সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করে ছাড়বে।
মূল্যায়ন: একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যায় নদেরচাঁদ নদীর সন্তান। মায়ের ছেলে মায়ের কোলেই মিশে গেল। অসহায় নদেরচাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সভ্যতার এক সর্বনাশা পরিণামকে অঙ্কিত করা হয়েছে।