Posts

নির্মল ভারত অভিযান ও স্বচ্ছ ভারত মিশন

নির্মল ভারত অভিযান ও স্বচ্ছ ভারত মিশন

ভারতবর্ষের মতো একটি বিশাল ও জনবহুল দেশে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এই জনস্বাস্থ্যের ভিত্তিমূলে রয়েছে পরিচ্ছন্নতা বা স্যানিটেশন। দশকের পর দশক ধরে, গ্রামীণ ভারতে উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্ম (Open Defecation) কেবল লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যহানি ও শিশুমৃত্যুর কারণ হয়ে থাকেনি, এটি নারী নিরাপত্তা এবং মানবিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও এক গভীর সংকট তৈরি করে রেখেছিল। এই ব্যাপক ও জটিল সমস্যার মোকাবিলায় ভারত সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এই অধ্যায়ে, আমরা ভারতের স্যানিটেশন যাত্রার দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়— 'নির্মল ভারত অভিযান' (NBA) এবং তার পরবর্তী রূপ 'স্বচ্ছ ভারত মিশন' (SBM) — নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমরা এই কর্মসূচিগুলির ইতিহাস, তাদের লক্ষ্য, কার্যকারিতা এবং ভারতীয় সমাজে তাদের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করব।

ভারতের স্যানিটেশন কর্মসূচির ইতিহাস ও বিবর্তন

ভারতের গ্রামীণ স্যানিটেশনের যাত্রাকে বুঝতে হলে তার ঐতিহাসিক বিবর্তনকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন।
ধাপ ১: সেন্ট্রাল রুরাল স্যানিটেশন প্রোগ্রাম (CRSP, ১৯৮৬): 
এটি ছিল স্বাধীন ভারতে গ্রামীণ পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রথম বড় মাপের সরকারি উদ্যোগ। কিন্তু এই কর্মসূচিটি ছিল মূলত 'সরবরাহ-ভিত্তিক' (Supply-Driven)। অর্থাৎ, সরকার থেকে শৌচাগার নির্মাণ করে দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন বা শৌচাগারের ব্যবহারের দিকে বিশেষ নজর না দেওয়ায় এই কর্মসূচিটি ব্যর্থ হয়।
ধাপ ২: সম্পূর্ণ স্যানিটেশন অভিযান (TSC, ১৯৯৯): 
১৯৯৯ সালে, পূর্ববর্তী কর্মসূচির ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে 'সম্পূর্ণ স্যানিটেশন অভিযান' (Total Sanitation Campaign - TSC) চালু করা হয়। এটি ছিল 'চাহিদা-ভিত্তিক' (Demand-Driven)। এখানে প্রথমবার শৌচাগার নির্মাণের পাশাপাশি তথ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগের (IEC) মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শৌচাগার ব্যবহারের চাহিদা তৈরির চেষ্টা করা হয়। এই সময়েই সফল পঞ্চায়েতগুলিকে উৎসাহিত করতে 'নির্মল গ্রাম পুরস্কার' (NGP) চালু হয়।
ধাপ ৩: নির্মল ভারত অভিযান (NBA, ২০১২):
'সম্পূর্ণ স্যানিটেশন অভিযান' (TSC)-কেই ২০১২ সালের ১লা এপ্রিল পুনর্গঠন করে 'নির্মল ভারত অভিযান' (Nirmal Bharat Abhiyan - NBA) নামে চালু করা হয়।
কার আমলে: এই কর্মসূচিটি যখন চালু হয়, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডঃ মনমোহন সিং (Dr. Manmohan Singh) এবং এটি UPA-II সরকারের আমলে রূপায়িত হয়েছিল।
নির্মল ভারত অভিযান (NBA) - বিস্তারিত আলোচনা:
'নির্মল ভারত অভিযান' (NBA) পূর্ববর্তী TSC-এর লক্ষ্যগুলিকে আরও প্রসারিত করে এবং ২০২২ সালের মধ্যে গ্রামীণ ভারতকে 'উন্মুক্ত স্থানে শৌচমুক্ত' (Open Defecation Free - ODF) করার একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে।
NBA-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য:
আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি: এই অভিযানে ব্যক্তিগত পারিবারিক শৌচাগার (IHHL) নির্মাণের জন্য সরকারি সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয় (প্রায় ৪,৬০০ টাকা পর্যন্ত)।
লক্ষ্যমাত্রা: ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েতকে ODF করা।
সামগ্রিক পরিচ্ছন্নতা: শুধুমাত্র শৌচাগার নির্মাণ নয়, এই প্রথমবার 'কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা' (Solid and Liquid Waste Management - SLWM)-কে গ্রামীণ স্যানিটেশন কর্মসূচির অংশ করা হয়।
সচেতনতা: তথ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগ (IEC)-এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
প্রাতিষ্ঠানিক স্যানিটেশন: বিদ্যালয় এবং অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা শৌচাগার নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা হয়।
NBA-এর সীমাবদ্ধতা:
যদিও NBA-এর লক্ষ্যমাত্রা স্পষ্ট ছিল, তবুও এর অগ্রগতি ছিল অত্যন্ত ধীর। এটি মূলত একটি সরকারি প্রকল্প হিসেবেই থেকে যায়, একে 'গণ-আন্দোলন'-এ পরিণত করা সম্ভব হয়নি। শৌচাগার নির্মাণের উপর যতটা জোর দেওয়া হয়েছিল, তার ব্যবহার নিশ্চিত করা বা মানুষের আচরণগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ততটা সাফল্য আসেনি।

ধাপ ৪: স্বচ্ছ ভারত মিশন (SBM): 
এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ।
'নির্মল ভারত অভিযান'-এর ধীর গতি এবং সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে, ২০১৪ সালে ভারতে এক নতুন সরকার এই সম্পূর্ণ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়।

চালু ও রূপান্তর:
২০১৪ সালের ২রা অক্টোবর, মহাত্মা গান্ধীর জন্মবার্ষিকীতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) 'নির্মল ভারত অভিযান'-কে একটি নতুন, সময়-ভিত্তিক 'মিশন মোড'-এ রূপান্তরিত করেন এবং 'স্বচ্ছ ভারত মিশন' (Swachh Bharat Mission - SBM) চালু করেন।
এটি কেবল একটি rebranding ছিল না; এটি ছিল লক্ষ্যের, পদ্ধতির এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার এক আমূল পরিবর্তন।

স্বচ্ছ ভারত মিশনের (গ্রামীণ) বিস্তারিত আলোচনা:
SBM-কে ভারতের স্যানিটেশন ইতিহাসে সবচেয়ে সফল কর্মসূচি হিসেবে গণ্য করা হয়। এর সাফল্যের পিছনে ছিল নির্দিষ্ট কিছু কারণ 
সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব: প্রধানমন্ত্রী নিজে এই মিশনের নেতৃত্ব দেন, যা দেশের সমস্ত প্রশাসনিক স্তরে এক অভূতপূর্ব তৎপরতা তৈরি করে। এটি একটি সরকারি 'প্রকল্প' না থেকে একটি জাতীয় 'গণ-আন্দোলন'-এ (Jan Andolan) পরিণত হয়।
নির্দিষ্ট সময়সীমা: ২রা অক্টোবর ২০১৯ (মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী)-এর মধ্যে ভারতকে ODF করার এক সুনির্দিষ্ট, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং সময়-ভিত্তিক (Time-bound) লক্ষ্য স্থির করা হয়।
আচরণগত পরিবর্তনে সর্বাধিক জোর (Behavioural Change): SBM-এর সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল এটি। এই মিশন উপলব্ধি করে যে, আসল সমস্যা শৌচাগারের অভাব নয়, আসল সমস্যা মানুষের মানসিকতা ও অভ্যাস। তাই শৌচাগার নির্মাণের পাশাপাশি এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়।
আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি: ব্যক্তিগত শৌচাগার (IHHL) নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তা বাড়িয়ে ১২,০০০ টাকা করা হয় (কেন্দ্র ও রাজ্যের অংশ মিলিয়ে)।
ODF স্থিতি যাচাই: শৌচাগার নির্মাণের পরিসংখ্যানের পাশাপাশি, গ্রামগুলি সত্যিই ODF হয়েছে কিনা তা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যাচাই (Verification) করার ব্যবস্থা চালু করা হয়।

SBM ২.০: পরবর্তী পদক্ষেপ (ODF প্লাস)
২০১৯ সালে গ্রামীণ ভারতকে ODF ঘোষণার পর, এই সাফল্যকে ধরে রাখা এবং পরিচ্ছন্নতাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য 'স্বচ্ছ ভারত মিশন (গ্রামীণ) দ্বিতীয় পর্যায়' (SBM 2.0) চালু করা হয়েছে (২০২০-২০২৫)।
SBM ২.০-এর মূল লক্ষ্য হলো 'ODF প্লাস' (ODF Plus) অর্জন করা। এর অর্থ:
ODF স্থায়িত্ব: গ্রামগুলি যেন ODF স্থিতি বজায় রাখে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: কঠিন বর্জ্য (প্লাস্টিক, আবর্জনা) এবং তরল বর্জ্য (নর্দমার জল) ব্যবস্থাপনার পরিকাঠামো তৈরি করা।
মলমূত্র বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (FSM): শৌচাগারের পিট বা সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে উৎপন্ন বর্জ্যের বৈজ্ঞানিক উপায়ে নিষ্পত্তি করা।
উপসংহার:
ভারতের স্যানিটেশন যাত্রা ১৯৮৬ সালের একটি ব্যর্থ 'সরবরাহ-ভিত্তিক' মডেল থেকে শুরু হয়ে, 'নির্মল ভারত অভিযান'-এর মাধ্যমে একটি কাঠামোগত রূপ পায়। অবশেষে 'স্বচ্ছ ভারত মিশন'-এর মাধ্যমে এটি একটি বৈপ্লবিক 'গণ-আন্দোলন'-এ পরিণত হয়। এই যাত্রা কেবল কোটি কোটি শৌচাগার নির্মাণের গল্প নয়, এটি ভারতের গ্রামীণ সমাজে স্বাস্থ্য, মর্যাদা এবং নারীর ক্ষমতায়নের এক নীরব বিপ্লবের কাহিনী।


Post a Comment